ভারতবর্ষের ইতিহাস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভাদ্র , ১৩০৯
ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্নকাহিনীমাত্র। কোথা হইতে কাহারা আসিল , কাটাকাটি মারামারি পড়িয়াগেল , বাপে -ছেলেয় ভাইয়ে-ভাইয়ে সিংহাসন লইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল , একদল যদি বা যায় কোথা হইতে আর – একদল উঠিয়া পড়ে পাঠান-মোগল পর্তুগীজ-ফরাসী-ইংরাজ সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে উত্তরোত্তর জটিল করিয়া তুলিয়াছে ।
কিন্তু এই রক্তবর্ণে রঞ্জিত পরিবর্তমান স্বপ্নদৃশ্যপটের দ্বারা ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করিয়া দেখিলে যথার্থ ভারতবর্ষকে দেখা হয় না। ভারতবাসী কোথায় এ – সকল ইতিহাস তাহার কোনো উত্তর দেয় না। যেন ভারতবাসী নাই কেবল যাহারা কাটাকাটি খুনাখুনি করিয়াছে তাহারাই আছে ।
তখনকার দুর্দিনেও এই কাটাকাটি -খুনাখুনিই যে ভারতবর্ষের প্রধানতম ব্যাপার তাহা নহে । ঝড়ের দিনে যে ঝড়ই সর্বপ্রধান , তাহা তাহার ঘটনা গর্জনসত্ত্বেও স্বীকার করা যায় না –সেদিনও সেই ধূলিসমাচ্ছন্ন আকাশের মধ্যে পল্লীর গৃহে গৃহে যে জন্মমৃত্যু-সুখদুঃখের প্রবাহ , তাহা ঢাকা চলিতে থাকে পড়িলেও , মানুষের পক্ষে তাহাইপ্রধান । কিন্তু বিদেশী পথিকের কাছে এই ঝড়টাই প্রধান , এই ধূলিজালই তাহার চক্ষে আর করে , – সমস্তই গ্রাস ; কারণ ভিতরে , সে ঘরের বাহিরে ।সেইজন্য বিদেশীর ইতিহাসে এই সে ঘরের নাই ধূলির কথা ঝড়ের কথাই পাই , ঘরের কথা কিছুমাত্র পাই না। সেই ইতিহাস পড়িলে মনে হয়, ভারতবর্ষ তখন ছিল না, কেবল মোগল-পাঠানের গর্জনমুখর বাত্যাবর্ত শুষ্কপত্রের ধ্বজা তুলিয়া উত্তর হইতে দক্ষিণে এবং পশ্চিম হইতে পূর্বেঘুরিয়া ঘুরিয়াবেড়াইতেছিল ।
দেশ তখনো , কিন্তু বিদেশ যখন ছিল , ছিল নহিলে এই -সমস্ত উপদ্রবের মধ্যে কবীর নানক চৈতন্য তুকারাম ইঁহাদিগকে জন্ম দিল কে ? তখন যে কেবল দিল্লি ছিল তাহা নহে কাশী এবং নবদ্বীপও এবং আগ্রা , ছিল । তখন প্ৰকৃত ভারতবর্ষের মধ্যে যে জীবনস্রোত বহিতেছিল , যে , চেষ্টার তরঙ্গ উঠিতেছিল যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটিতেছিল , তাহার বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায়না ৷
কিন্তু বর্তমান পাঠ্যগ্রন্থেরবহির্ভূত সেই ভারতবর্ষের সঙ্গেই আমাদের যোগ । সেই যোগের বহুবর্ষকালব্যাপী ঐতিহাসিক সূত্র বিলুপ্ত হইয়া গেলে আমাদের হৃদয় আশ্রয় পায় না ।আমরা ভরতবর্ষের আগাছা -পরগাছা নহি ; বহুশত শতাব্দীর মধ্য দিয়া আমাদের শতসহস্র শিকড় ভারতবর্ষের মর্মস্থান অধিকার করিয়া আছে।কিন্তু দুরদৃষ্টক্রমে এমন ইতিহাস আমাদিগকে পড়িতে হয় যে , ঠিক সেই কথাটাই আমাদের ছেলেরা ভুলিয়া যায়। মনে হয় , ভারতবর্ষের মধ্যে আমরা যেন কেহই না , আগন্তুকবর্গই যেন সব।
নিজের দেশের সঙ্গে নিজের সম্বন্ধ এইরূপ অকিঞ্চিৎকর , বলিয়া জানিলে কোথা হইতে আমরা প্রাণ আকর্ষণ করিব ? এরূপ অবস্থায় বিদেশকে স্বদেশের স্থানে বসাইতে আমাদের মনে দ্বিধামাত্রহয় না—ভারতবর্ষের অগৌরবে আমাদের প্রাণান্তকর লজ্জাবোধ হইতে পারে না । আমরা অনায়াসেই বলিয়া থাকি , পূর্বে আমাদের কিছুই ছিল না , এবং এখন আমাদিগকে অশনবসন আচারব্যবহার সমস্তই বিদেশীর কাছ হইতে ভিক্ষা করিয়া লইতে হইবে ।
যে – সকল দেশ ভাগ্যবান্ তাহারা চিরন্তন স্বদেশকে দেশের ইতিহাসের মধ্যেই খুঁজিয়া পায়, বালককালে ইতিহাসই দেশের সহিত তাহাদের পরিচয়সাধন করাইয়া দেয় । আমাদের ঠিক তাহার উল্টা । দেশের ইতিহাসই আমাদের স্বদেশকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে । মামুদের আক্রমণ হইতে লর্ড কার্জনের সাম্রাজ্যগর্বোদ্গার – কালপর্যন্তযে -কিছু ইতিহাসকথা তাহা ভারতবর্ষের পক্ষে বিচিত্র কুহেলিকা ; তাহা স্বদেশ সম্বন্ধেআমাদের দৃষ্টিরসহায়তা না দৃষ্টি করে , আবৃত করে মাত্র। তাহা এমন স্থানে কৃত্রিম আলোক ফেলে যাহাতে আমাদের দেশের দিকটাই আমাদের চোখে অন্ধকার হইয়া যায় । সেই অন্ধকারের মধ্যে নবাবের বিলাসশালার দীপালোকে নর্তকীর মণিভূষণ জ্বলিয়া , বাদশাহের সুরাপাত্রের ফেনোচ্ছ্বাস উঠে রক্তিম উন্মত্ততার জাগররক্ত দীপ্তনেত্রের ন্যায়দেখা দেয় ; সেই অন্ধকারে আমাদের প্রাচীন দেবমন্দির -সকল ; মস্তক আবৃত করে এবং সুলতান -প্রেয়সীদের শ্বেতমর্মররচিত কারুখচিত কবরচূড়া নক্ষত্রলোক চুম্বনকরিতে উদ্যত হয় ।সেই অন্ধকারের মধ্যে অশ্বের , বৃংহিত ঝঞ্ঝনা সুদূরব্যাপী ক্ষুরধ্বনি হস্তীর , অস্ত্রের , শিবিরের তরঙ্গিত কিংখাব – আস্তরণের স্বর্ণচ্ছটা মসজিদে পাণ্ডুরতা ফেনবুদাকার , পাষাণমণ্ডপ , খোজাপ্রহরিরক্ষিত প্রাসাদ-অন্তঃপুরে রহস্যনিকেতনের নিস্তব্ধ মৌন — এ -সমস্তই বিচিত্র শব্দে ও বর্ণে ও ভাবে যে প্রকাণ্ডইন্দ্রজাল রচনা করে তাহাকে ভারতবর্ষের ইতিহাস বলিয়া লাভ কী ? তাহা ভারতবর্ষের পুণ্যমন্ত্রের পুঁথিটিকে একটি অপরূপ আরব্য উপন্যাস দিয়া মুড়িয়া রাখিয়াছে—সেই পুঁথিখানি কেহ খোলে না , সেই আরব্য উপন্যাসেরই প্রত্যেক ছত্র ছেলেরা মুখস্থ করিয়া লয় ।তাহার পরে প্রলয়রাত্রে এই মোগলসাম্রাজ্য যখন মুমূর্ষু তখন শ্মশানস্থলে দূরাগত গৃধ্রগণের পরস্পরের মধ্যে যে -সকল চাতুরী প্রবঞ্চনা হানাহানি পড়িয়াগেল , তাহাও কি ভারতবর্ষের ইতিবৃত্ত ? এবং তাহার পর হইতে পাঁচ পাঁচ বৎসরে বিভক্ত ছক -কাটা শতরঞ্চের মতো ইংরাজশাসন , ইহার মধ্যে ভারতবর্ষ আরো ক্ষুদ্র; বস্তুতশতরঞ্চের সহিত ইহার প্রভেদ এই যে ইহার ঘরগুলি কালোয় সাদায় সমান বিভক্ত , ইহার পনেরো -আনাই নহে সাদা । আমরা পেটের অন্নের বিনিময়ে সুশাসন সুবিচার সুশিক্ষা সমস্তই একটি