নির্বাচনী তহবিল বণ্ড– আইন ও তথ্য বিশেষ।
সৈকত বসু
ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ‘সুপ্রীম কোর্ট’ হিসেবে পরিচিত। সুপ্রীম কোর্টের রায় চূড়ান্ত এবং বাধ্যতামূলক। এর মানে অবশ্য এই নয় যে সুপ্রীম কোর্ট প্রদত্ত সমস্ত রায়ই ‘সঠিক’। সুপ্রীম কোর্ট অবশ্য তা দাবীও করেনা। কারন সমস্ত রায় যদি সঠিক হত তাহলে ৫ জজ বিশিষ্ট বেঞ্চ, ৭ জজ বিশিষ্ট বেঞ্চ প্রভৃতির প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু যতদিন একটি রায় বহাল থাকে ততদিন ওই রায় মানা বাধ্যতামূলক– এটাকে আইনের শাসন বলা হয়ে থাকে। আমার মতে নির্বাচনী বণ্ড সংক্রান্ত রায় সঠিক নয়। কিন্তু এই রায় মানাটা বাধ্যতামূলক।
আইন বিজ্ঞান নয়। যদিও এরকম দাবী মাঝে মাঝে করা হয়ে থাকে। আইন পর্যালোচনা করতে গেলে আইনি ব্যবস্থাটা মামলার আগে ঠিক কীরকম ছিল জানাটা জরুরী। কারণ, এর থেকে জজ সাহেবরা বিচার করেন ঠিক কোন সমস্যাটার সুরাহা করার জন্য এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এটাকে আইনি পরিভাষায় ‘mischief rule’ বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ কোনো mischief-এর জন্য আইনে কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এই অনুসন্ধিৎসা বিচারের জন্য আবশ্যিক। আমার মতে এই ‘অনুসন্ধিৎসা’ এই রায়ের দুর্বল অংশ।
খুব সাধারণ বলতে গেলে জজ সাহেবরাও মানুষ। তাদেরও রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে– তাঁরাও ভোট দেন। আর এই মতাদর্শগত অবস্থান অনেক সময়ই তাদেরকে কর্তব্য পথ থেকে বিচ্যুত করে। মানে, ধরুন ইন্দিরা গান্ধীকে অন্যায় ভাবে আগাম জামিন দেওয়ার মধ্যে আইনের অপপ্রয়োগ ও রাজনীতি থাকে– আইন থাকে না। আবার ব্যাপারটা অন্য মাত্রায় চলে যায় যখন সেই বিচারক, তার জেরে, ভারতের প্রধান বিচারপতির পদ অলঙ্কৃত করেন।
আমাদের গণতন্ত্র হল প্রতিনিধিমূলক অর্থাৎ representative democracy। এই প্রতিনিধিরা হল নির্বাচিত প্রতিনিধি অর্থাৎ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হন তাঁরা। তাই নির্বাচন আমাদের গণতন্ত্রের এক অব্যশ্যম্ভাবী অঙ্গ বিশেষ। আবার নির্বাচন লড়তে টাকা লাগে– অর্থের যোগান দেয় পার্টির সাধারণ কর্মীরা, অর্থবান নেতারা এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্র। সরকারী পক্ষ ক্ষমতায় থাকার সুবাদে বেশি অর্থ পায়; বিরোধীরা কম পায়। এই ক্ষমতাকেন্দ্রীক পুঁজি যা দিয়ে নির্বাচনী তহবিল গঠন হয় তাতে দীর্ঘদিন যাবৎ কংগ্রেসের একচেটিয়া দখল ছিল। সেদিন অবশ্য level playing field বা সুষম প্রতিযোগিতার তত্ত্ব, গণতান্ত্রিক আখ্যানের অন্তর্ভুক্ত ছিল না– যা আজকের ‘গণতান্ত্রিক’-আসরে এক অভূতপূর্ব মত্ত বিলাস।
কিন্তু কংগ্রেস করেনি বলে রাষ্ট্র স্বচ্ছ হবে না বা হবার চেষ্টা করবে না, তা তো নয়। তাই ভারত সরকার একটি আইন প্রনয়ণ করল। আর এই মূল আইনকে বলবৎ করার জন্য অনেকগুলি সংশ্লিষ্ট আইনে সংশোধনী আনা হলো। এই আইন ও সামূহিক সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হল সুপ্রীম কোর্টে। একটি বিশেষ সংবিধান বেঞ্চ এই মামলা শুনে রায় প্রদান করল– সেই রায় এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু।
এবার আইনি কাঠামোর দিকে তাকানো যাক। ১৯৫৬র কোম্পানি আইনে রাজনৈতিক দলগুলিকে অর্থ দান করার ব্যাপারে কিছু বলা ছিল না– ১৯৬০-এর সংশোধনীতে প্রথম এই ব্যাপারটা উল্লিখিত হয়। একটা ২৫০০০-এর সীমা ছিল। আইনে এটাও উল্লিখিত থাকে যে মোট দানের পরিমান ও কোন পার্টিকে দান করা হয়েছে তা লাভ-লোকসানের খাতাতে প্রকাশ করা কোম্পানির ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। এর পরের সংশোধনী গুলোতে যাবার প্রয়োজন না থাকায় অনুল্লিখিত রইল। আমরা এবার সোজা চলে যাব কোম্পানি আইন ২০১৩তে। ২০১৩র ১৮২ নম্বর ধারাতে বলা হল রাজনৈতিক দলকে দান করার কথা। ওই ধারা অনুযায়ী, যে কোন রাজনৈতিক দলকে যথেচ্ছ পরিমাণ টাকা দান করার জন্য কোম্পানির অধিকার ন্যস্ত হলো– দুটো লক্ষ্মণরেখা টানা হল। এক, কোনো সরকারী কোম্পানির ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য নয়। দুই, তিনবছরের গড় আয়ের ৭.৫ শতাংশের বেশি দান করার অধিকার কোম্পানির থাকবেনা। এই দানের সম্পর্কে বোর্ড অব ডাইরেক্টরের গৃহীত-সিদ্ধান্তও উল্লিখিত থাকতে হবে। আইনে অবশ্য এই দানের পূর্ণাঙ্গ হিসেব প্রকাশ করার দায়বদ্ধতা থাকে। আরও, দানগ্রাহী রাজনৈতিক দলের নাম প্রকাশের দায়িত্ব থাকে।
Finance Act, ২০১৭ তিনটি সংশোধনী আনে ১৮২ ধারাতে–
(১) সংশোধনী মোতাবেক দানের উচ্চসীমা রদ হয়।
(২) সংশোধন অনুসারে কোন রাজনৈতিক দলকে দান করছে, কোম্পানি তা জানাতে বাধ্য নয়।
(৩) কোম্পানি শুধুমাত্র চেক, ব্যাঙ্ক ড্রাফট, বৈদ্যুতিন বিনিময় ও নির্বাচনী বণ্ড দ্বারা এই অর্থ প্রদানে সক্ষম।
সংশোধনী আনা হলো ট্যাক্স আইনেও। এই সংশোধনী মোতাবেক প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে ট্যাক্সের আওতার বাইরে রাখা হলো। কিন্তু এই ছাড় পাওয়ার আবশ্যিক শর্ত হলো তিনটি–
(১) সমস্ত হিসেবের খাতা ও আনুষঙ্গিক দলিল দস্তাবেজ পরীক্ষণের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে।
(২) ২০০০০ টাকার ওপর দানের পূর্ণাঙ্গ হিসেব রাখতে হবে, দাতার বিশদ বিবরণ সহ।
(৩) প্রত্যেক বছর একাউন্ট অডিট করাতে হবে।
এই ট্যাক্স সংশোধন মোতাবেক–
(অ) দাতা কোম্পানি দান করা অর্থের ওপর ছাড় পাবে।
(আ) রাজনৈতিক দলগুলি ২০০০ টাকার ওপর দান শুধুমাত্র চেক, ড্রাফট ও আনুষঙ্গিক উপায়ে নিতে পারবে।
(ই) ইলেক্টোরাল বণ্ডের দ্বারা প্রাপ্ত দানের কোনো হিসেব রাজনৈতিক দলগুলিকে রাখতে হবে না।
এর আগে election and other related laws 2003 সংশোধিত হয়েছে। সংশোধনের ফলে জনপ্রতিনিধি আইনে একটি নতুন ধারা সংযোজিত হয়েছে। ২৯ক ধারা মোতাবেক সমস্ত রাজনৈতিক দলকে, আবশ্যিক ভাবে, পূর্ণাঙ্গ হিসেব দাখিল করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এই হিসাবে উল্লিখিত থাকবে ২০০০০ টাকার ওপর দান করা প্রত্যেকটি দাতার খুঁটিনাটি। এই হিসাব দাখিল করার পর, নির্বাচনী কমিশনের ছাড়পত্র পাওয়ার অপেক্ষা করতে হবে। ছাড়পত্র পাওয়ার পর, এই হিসাব দাখিল করতে হবে আয়কর দপ্তরের কাছে– অন্যথায় ছাড় রদ হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কংগ্রেস এই হিসাব দাখিল না করার কারণেই তার ছাড় রদ হয়েছে। এতে রাজনীতি নেই, আইন আছে।
আর একটি সংশোধনীর দ্বারা বলা হলো যে ইলেক্টোরাল বণ্ড দ্বারা প্রাপ্ত দানের হিসাব কোনো রাজনৈতিক দলকে দাখিল করতে হবে না।
মোটামুটি ভাবে যা পাওয়া গেল–
(১) রাজনৈতিক দলগুলিকে শর্তসাপেক্ষে ইনকাম ট্যাক্সের আওতা থেকে ছাড় দেওয়া হ’ল।
(২) রাজনৈতিক দলকে দান করা টাকার ওপর ইনকাম ট্যাক্স ছাড় দেওয়া হ’ল।
(৩) ২০০০ টাকার ওপর দান শুধুমাত্র চেক বা সংশ্লিষ্ট মাধ্যমের দ্বারাই প্রযোজ্য।
(৪) কোম্পানি কোন রাজনৈতিক দলকে দান করছে তা প্রকাশ করতে বাধ্য নয়।
এই আইনি পরিকাঠামোতে ইলেক্টোরাল বণ্ড স্কীম ঘোষিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ থাকে যে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও মূখ্য নির্বাচন কমিশন দুজনেই এই ইলেক্টোরাল বণ্ডের বিরূদ্ধে তাদের মত দেয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মূল বক্তব্য ছিল যে ইলেক্টোরাল বণ্ড বাজারে অতিরিক্ত একটি ইনস্ট্রুমেন্ট(অর্থপত্র–লেনদেন নথি) হিসেবে কাজ করবে এবং অর্থ-বাজারে অস্থিরতা তৈরি করবে। রিজার্ভ ব্যঙ্কের এই মতকে স্বীকৃতি দিয়ে বণ্ড নবীকরনের সীমা মাত্র ১৫ দিন করা হয়। নির্বাচনী কমিশনরের অস্বচ্ছতার যুক্তিতে কোনো সারবত্তা পায় না আইন প্রণেতারা। এই প্রেক্ষাপটে সরকার ঘোষণা করে ইলেক্টোরাল বণ্ড স্কীম।
২০১৮ সালের ২রা জানুয়ারি সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষিত হলো এবং বাজারে ইলেক্টোরাল বণ্ড নামক এক নতুন কর্জ-পত্র বাজারে প্রবর্তিত হলো। এই ইলেক্টৌরাল বণ্ডের মূল বৈশিষ্টগুলি নিচে উল্লিখিত হলো–
(১) যে কোন ব্যক্তি যিনি ভারতের নাগরিক অথবা ভারতে পঞ্জিকৃত কোম্পানি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিধিবদ্ধ সংস্থাবর্গ এই বণ্ড কিনতে পারবে।
(২) ইলেক্টোরাল বণ্ড শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলি ভাঙ্গাতে পারবে। যে কোন রাজনৈতিক দলই যা জনপ্রতিনিধি আইনের ২৯ক আইন মোতাবেক নিবন্ধিত ও শেষ-নির্বাচনে, লোকসভা বা বিধানসভায় ন্যুনতম ১ শতাংশ ভোট পেয়েছে– শুধুমাত্র সেই রাজনৈতিক দলই এই ইলেক্টোরাল বণ্ডের মাধ্যমে দান পাওয়ার অধিকারী।
(৩) KYC নিয়ম প্রযোজ্য।
(৪) চেক, ড্রাফট, বৈদ্যুতিন বিনিময় পদ্ধতি ও অন্যান্য সহযোগী পদ্ধতির মাধ্যমেই বণ্ড ক্রয় সম্ভব।
(৫) বন্ডের ইস্যু মূল্য যথাক্রমে ১০০০,১০০০০, ১,০০,০০০, ১০,০০,০০০ ও ১,০০,০০,০০০ ভারতীয় টাকা।
(৬) বণ্ড ইস্যু হবার পর ১৫ দিনের জন্য বৈধ থাকবে। ১৫ দিনের মধ্যে ভাঙ্গানো না হলে বণ্ডের সমমূল্যের টাকা চলে যাবে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে।
(৭) বণ্ডের টাকা ফেরতযোগ্য নয়।
(৮) বণ্ড বছরে চারবার ইস্যু করা হবে।
আমরা এবার তাকাবো কিছু আইনি সুত্রের দিকে। এর প্রথম সুত্র হল ‘অনুমান সুত্র’। এই সুত্র অনুসারে যখনই কোনো আইনকে অসাংবিধানিক বলে চ্যালেঞ্জ করা হয় তখন এই ‘অনুমান সুত্র’ অনুযায়ী আদালত ধরে নেয় যে, আইনটি সাংবিধানিক এবং আইনটিকে অসাংবিধানিক প্রমাণ করার দায় দরখাস্তকারীর ওপর বর্তায়। এই সুত্রের একটি সহজ ব্যাখ্যা আছে। আইন প্রনয়নকারীরা নির্বাচিত সদস্য। তাঁরা সমাজ ও মানুষের সমস্যা সম্বন্ধে অবহিত সুতরাং তাঁরা সচেতন ভাবে সমস্যা নিরসনের জন্য যে আইন বানান তা সাংবিধানিক।
কিন্তু এই অনুমান সুত্র উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে যদি প্রাথমিক নিরীক্ষণে এটা আপাতভাবে মনে হয় যে আইনটি সাংবিধানিক-ভাবে-স্বীকৃত কোনো মৌলিক-অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে।
আমরা জানি, ‘তথ্য জানার অধিকার’ সুপ্রীম কোর্টের বিচার অনুযায়ী এক মৌলিক অধিকার। আর পূর্ব উল্লিখিত সংশোধনী অনুযায়ী, কোম্পানি কোন রাজনৈতিক দলকে ইলেকটোরাল বণ্ডের মাধ্যমে দান করেছে জানাতে বাধ্য নয়। অর্থাৎ কোনো নাগরিক যদি জানতে চায় যে, কোন কোম্পানি কোন দলকে কত অর্থ প্রদান করেছে তাহলে সংশোধিত আইনি কাঠামোতে সে অপারগ। তাহলে এই আইন ও সংশোধনী এক ‘সাংবিধানিক অধিকারে’ হস্তক্ষেপ করছে– সুতরাং এই আইন ও সামূহিক সংশোধনী অসাংবিধানিক। সুপ্রীম কোর্ট আরও বলল যে, প্রতিটি ভোটারের জানার অধিকার রয়েছে যে কোন পার্টি কোন কোম্পানির থেকে কত টাকা পেয়েছে। এখানে একান্তে জানিয়ে রাখার প্রয়োজন যে, যদিও তথ্য জানার অধিকার মৌলিক, সুপ্রীম কোর্ট কিন্তু নিজেকে সচেতন ভাবে এই আইনের আওতা থেকে সরিয়ে রেখেছে। এমন কি জজ সাহেবদের ক্ষেত্রে ব্যক্তি সম্পত্তির হিসাব ঘোষণার ব্যাপারটাও ‘ইচ্ছাধীন’। মানে গণতন্ত্রের ভালো মন্দ বিচার করার দায় যে প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত সেই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিভূমি হচ্ছে অগণতান্ত্রিক!
আরও একটা ব্যাপার খুব মজার। আমাদের বর্তমান আইন অনুসারে জজ সাহেবেদের নিয়োগের ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিদের কোন ভূমিকা নেই। মানে তাঁরা নিজেরাই নিজেদেরকে নিয়োগ করেন। যদিচ সংবিধান সে কথা বলে না। মানে নতুন আইন অনুসারে বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে We the people প্রযোজ্য নয়। তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা we the judges – মানে একটা স্বয়ংকৃত ব্যবস্থা তথা রীতি যা-তে জনপ্রতিনিধিদের কোন ভূমিকা নেই। অথচ representative democracyতে জনপ্রতিনিধিই অবিচ্ছেদ্য ভিত্তি।
আমরা এবার একটু অন্যদিকে তাকাবো। কারন সুপ্রীম কোর্টের সামনে আর একটি ইস্যু ছিল এই মামলায়– ইলেকটোরাল বণ্ডের মাধ্যমে যদি রাজনৈতিক দলগুলি (পড়ুন বিজেপি) টাকা তোলে তাহলে মুক্ত এবং স্বাধীন নির্বাচনী প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে কিনা এবং প্রকারান্তরে সংবিধানের ১৪ নং ধারা লঙ্ঘিত হবে কিনা!
এ প্রসঙ্গে সুপ্রীম কোর্ট দীর্ঘ আলোচনার অবতারনা করেছেন। বিভিন্ন নজির দেখিয়েছেন– উদ্ধৃতি দিয়েছেন তাদের যুক্তির স্বপক্ষে। দেখিয়েছেন অর্থ-শক্তি কীভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে। আমার এর বিরূদ্ধে কিছু বলার নেই। আমি খালি বলব যে, আইনী পরিভাষায় misdirected বলে একটা কথা বলা হয়ে থাকে। মানে ধরুন একটা বাঙ্গলা প্রবাদ আছে, আমি মরছি আমার জ্বালায় / পঞ্চা আবার গোঁফ রেখেছে। এই জায়গাতে সুপ্রীম কোর্ট সম্পূর্ণ দিশাহীন। কেন দিশার অভাব পরিলক্ষিত হয়– তার কারণ খুব সরল। ‘নির্বাচনে টাকার প্রভাব’ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল না। নির্বাচনে যে অর্থের হাঁকডাক আছে এতো সর্বজনবিদিত। তার জন্য উদ্ধৃতির প্রয়োজন ছিল না। যেটা আলোচনার বিষয়বস্তু হওয়া উচিত ছিল, সেটা হল নির্বাচনে ‘কালো’ টাকার প্রভাব। আর তার পরের স্বাভাবিক প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিল এই প্রভাব কেমন করে কমানো যায়। এই নতুন আইন ও সামূহিক সংশোধনী কি নির্বাচনে কালো টাকার পরিমাণ কমাতে সাহায্য করবে? এবং প্রয়োজনে কি আইনটার কাটছাঁট করা যায় যাকে আইনের পরিভাষায় reading down the law বলে?
আর সুপ্রীম কোর্ট তো নিজেই বলেছে দান সম্বন্ধীয় তথ্যগুলো তো লৌহ জালিকার ঘেরাটোপে নেই। কোম্পানিগুলি তো ROCর সামনে দাখিলা পেশ করে। এই দাখিলা পরীক্ষা করলেই তো বোঝা যাবে যে কোম্পানি কত টাকার ইলেক্টোরাল বণ্ড কিনেছে। কিন্ত সুপ্রীম কোর্ট এসব না করে অযথা সময় ব্যয় করল privacy এবং information অধিকারের তুলনামূলক আলোচনায়।
সংবিধান ভারসাম্যের দলিল। গণতন্ত্র সংবিধানের মূল স্তম্ভ হিসেবে চিহ্নিত। আমাদের দেশে নির্বাচন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে সচল রাখে। সেই নির্বাচন যদি কালো টাকায় ধর্ষিত হয় তাহলে গণতন্ত্র ধর্ষিত হবে। আর এই আইন ও সামূহিক সংশোধনী নির্বাচনকে কলুষ মুক্ত করে গণতন্ত্রকে সফল করবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল মানুষের তথ্যের অধিকারের সঙ্গে কলুষ মুক্ত নির্বাচন প্রক্রিয়ার অঙ্গীকারকে harmonise করা। কিন্তু কোর্ট সস্তা পথে হাঁটল। কখনও কখনও মনে হয় আসলে আদালত আগেই স্থির করেছিল যে কী রায় প্রদান করা হবে। হয়তো বা কোর্ট ভেবেছিলো এর মধ্যে লুকিয়ে আছে এমন অনেক তথ্য যা জনগণের গোচরে এলে অনেক হিসেব উল্টেপাল্টে যাবে। তা কিন্তু হয়নি।
কোর্ট কিন্তু কোম্পানিগুলোকে নোটিস করেনি। এই রায়দান একপক্ষকে না শুনে দেওয়া হলো। সেই একতরফা রায়ই বা কতটা যুক্তিযুক্ত বা নৈতিক তার থেকে বড় কথা হলো যে সেটা কতটা আইনসম্মত।
এই আইনের ফলে সরকারের দেওয়া sovreign guarantee ভূলুন্ঠিত হলো। কালো টাকাতে আচ্ছন্ন রইল গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া। সংবিধান বেঞ্চ সংবিধানকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলো– সাংবিধানিক কর্তব্য, নৈতিকতা এবং চেতনা নিহত হলো।
এরপরে আমরা একটু ডেটা বিশ্লেষণে মনোযোগী হব।
ডেটা বিশ্লেষণ করলে আমরা যে তথ্যগুলো পাই সেগুলো এবার একজায়গায় জড়ো করা যাক। আমরা প্রথম যে সংখ্যাটি পাই তা হলো ২২,২১৭। আসলে সর্বমোট ২২,২১৭টি নির্বাচনী বণ্ড কেনা হয়েছিল– কেনার সময়কাল ১লা এপ্রিল, ২০১৯ থেকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪।
এবার দেখা যাক কোন রাজনৈতিক দল কত টাকা পেয়েছে এই নির্বাচনী বণ্ডের মাধ্যমে। বোঝার সুবিধার জন্য আমি তথ্যগুলি সারণীতে পেশ করছি:
বিজেপি ₹৬,৯৮৬.৫ কোটি।
টিএমসি ₹১,৩৯৭ কোটি।
কংগ্রেস ₹১,৩৩৪ কোটি।
বিআরএস ₹১৩২২ কোটি।
ডিএমকে ₹৬৫৬.৫ কোটি।
এসপি ₹১৪.৫ কোটি।
বিজেডি ₹৯৪৪.৫ কোটি।
ওয়াইএসআর ₹৪৪৮.৮ কোটি।
টিডিপি ₹১৮১.৩৫ কোটি।
এই সারণীর দিকে তাকালে কতগুলি জিনিস খুব সুস্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথমত, সব রাজনৈতিক দলই কিন্তু নির্বাচনী বণ্ডের মাধ্যমে টাকা তুলেছে– একা বিজেপি নয়। সিপিএম অবশ্য সরাসরি পায়নি; নির্বাচনী বণ্ড মারফত ডিএমকে যে টাকা পেয়েছে তার থেকে ২৫ কোটি টাকা তারা সিপিএম-কে দিয়েছে। সিপিএম যথারীতি নির্বাচন কমিশনরের সামনে তাদের দায়ের করা এফিডেবিটে সেই প্রাপ্তি সম্বন্ধে নীরব থেকেছে।
নির্বাচনী বণ্ডের মারফত যে টাকা উঠেছে তার ৪৭
শতাংশ পেয়েছে বিজেপি। একটি আঞ্চলিক দল হিসেবে তৃনমূল কিন্তু কংগ্রেসকে পেছনে ফেলে দিয়েছে– এটা বেশ আশ্চর্যের ব্যাপার। আঞ্চলিক দলগুলি এই বণ্ডের মাধ্যমে প্রচুর টাকা পেয়েছে। প্রতিটি দল কত টাকা পেয়েছে, সেটাকে যদি আমরা সেই দলটির লোকসভায় নির্বাচিত জন-প্রতিনিধি দিয়ে ভাগ করি, তাহলে জনপ্রতিনিধি পিছু কত টাকা পেয়েছে প্রতিটি রাজনৈতিক দল, তার একটা হিসাব আমরা পাব। আমরা সেই হিসাবটাকে নিচের সারণীতে পেশ করছি:
জনপ্রতিনিধি পিছু–
টিডিপি ₹১১০ কোটি।
বিআরএস ₹২০০ কোটি।
ডিএমকে ₹৭৯ কোটি।
টিএমসি ₹৭৩ কোটি।
কংগ্রেস ₹২৭ কোটি।
বিজেপি ₹২০ কোটি।
এই সারণী থেকে যেটা লক্ষণীয় সেটা হলো নির্বাচনী বণ্ড থেকে মাথাপিছু আয় সবচেয়ে কম করেছে দুটি জাতীয় পর্যায়ের দল। সবচেয়ে বেশি আয় করেছে দক্ষিণের আঞ্চলিক দলগুলি। আর মাথাপিছু আয়-এ সবচেয়ে পেছনে আছে বিজেপি।
এখন নির্বাচনী বণ্ড তো দলগুলির একমাত্র আয়ের উৎস নয়। তাদের অন্য উৎসও আছে। তাহলে এই নির্বাচনী বণ্ড থেকে প্রাপ্ত আয়, পুরো আয়ের নিরিখে কত শতকরা, সেটা জানাটাও জরুরী। আমি সেই শতকরা হিসেব নিচের সারণীতে পেশ করলাম:
বিজেপি ৫১%
কংগ্রেস ৬৩%
টিএমসি ৯৩%
ডিএমকে ৯১%
বিজেডি ৯২%
টিআরএস ৮৩%
ওআইআরএস ৭৩%
এই সারণী থেকে এটা পরিষ্কার যে, আঞ্চলিক দলগুলি সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে নির্বাচনী বণ্ডের সুবাদে। শতকরা হিসাবে জাতীয় দলগুলি আঞ্চলিক দলগুলির চেয়ে অনেক পিছিয়ে। সবচেয়ে পেছনে আছে বিজেপি।
বিরোধী পক্ষের আর একটি দাবী যে, ইডি এবং সিবিআই লেলিয়ে, হাত মুচড়ে বিজেপি এই টাকা তুলেছে। আমরা এবার এই দাবী নজর করব। এই দাবীর প্রেক্ষিতে একটা বিশ্লেষনধর্মী লেখা ছাপিয়েছে ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস; তথ্য এবং ডেটা বিশ্লেষণ করে যে লেখাটি ছেপেছে, সেটা কিন্তু এই দাবীকে নস্যাৎ করার পক্ষে যথেষ্ট। দেখা যাচ্ছে ইডি এবং সিবিআই তল্লাশির পর বিজেপি মোট অর্থ-প্রদানের এর ৩৭.৩৪ শতাংশ পেয়েছে কিন্তু বিরোধী পক্ষ পেয়েছে প্রায় ৬৩ শতাংশ। আমরা ফিউচার গেমিং সংস্থার দিকে তাকাই। এই কোম্পানিটা তল্লাশি হওয়ার পরেই কিন্তু নির্বাচনী বণ্ড কিনতে শুরু করে। কিন্তু এই কোম্পানি যা নির্বাচনী বণ্ড কেনে তার সিংহ ভাগ পায় টিএমসি! আর তার পরে ডিএমকে। আমরা প্রতীতির প্রয়োজনে গোটা ব্যাপারটাকে সারণীতে রাখব–
টিএমসি ₹৫৪২ কোটি।
ডিএমকে ₹৫০৩ কোটি।
ওআইএসআর ₹১৫৪ কোটি।
বিজেপি ₹১০০ কোটি।
কংগ্রেস ₹৫০ কোটি।
অন্যদিকে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং(MEIL: Megha Engineering & Infrastructures Limited, Hyderabad) নির্বাচনী বণ্ড কিনেছে ₹১১০৭কোটির। এই নির্বাচনী বণ্ডের সিংহভাগ পেয়েছে বিজেপি। আমরা সারণীতে এটাও লিপিবদ্ধ করব–
বিজেপি ₹৫৮৪ কোটি।
বিআরএস ₹১৯৫ কোটি।
ডিএমকে ₹৮৫ কোটি।
ওআইআরএস ₹৩৭ কোটি।
টিডিপি ₹২৮ কোটি।
আমরা এবার তাকাবো হলদিয়া এনার্জির দিকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হলদিয়া এনার্জী হচ্ছে RPSG গ্রুপের অন্তর্গত একটি কোম্পানি– যে গ্রুপের মালিক সঞ্জীব গোয়েঙ্কা। হলদিয়া এনার্জী তল্লাশি হওয়ার আগে পর্যন্ত ₹২২কোটি টাকার নির্বাচনী বণ্ড কেনে। এই ₹২২কোটি টাকার মধ্যে ₹১৬কোটি পায় বিজেপি আর টিএমসি পায় ₹৬কোটি। তল্লাশির পর টিএমসি পায় ₹২৭৫কোটি আর বিজেপি পায় ₹৬৫কোটি।
নিচের সারণী থেকে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে–
টিএমসি ₹২৮১ কোটি।
বিজেপি ₹৮১ কোটি।
কংগ্রেস ₹১৫ কোটি।
RPSG গ্রুপের অন্য যে কোম্পানিরা টিএমসিকে অর্থ প্রদান করেছে, নিচের সারণীতে উল্লিখিত হল–
ধারিওয়াল ইনফ্রাস্ট্রাক্চর ₹৯০ কোটি
ফিলিপস কারবন ₹৫৩ কোটি
ক্রিসেন্ট পাওয়ার ₹৩৩ কোটি
RPSG ভেঞ্চার ₹০৩ কোটি।
তৃণমূলের প্রাপ্ত অর্থের ২৮.৭ শতাংশ একা RPSG প্রদান করে, যাদের মূল ব্যবসা বৃহত্তর কোলকাতার বিদ্যুৎ সরবরাহ। আমরা অবশ্য এই দানের সাথে সর্বভারতীয় তুলনায় সর্বাধিক মাশুলে, পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোন যোগসূত্র খুঁজব না।
মানে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ালো–
২০১৪-২২ ইডি তল্লাশি করেছে ৩০০০ বার।
এর মধ্যে মাত্র ২৬টি কোম্পানি নির্বাচনী বণ্ড কিনেছে।
এই ২৬টি কোম্পানির মধ্যে মাত্র ১৬টি কোম্পানি নির্বাচনী বণ্ড কিনেছে তল্লাশি হওয়ার পরপরই।
যাদের বিরূদ্ধে তল্লাশি হয়েছে, সেই কোম্পানিগুলো থেকে বিজেপি পেয়েছে ৩৭ শতাংশ আর বিরোধীরা পেয়েছে ৬৩ শতাংশ। অর্থাৎ যে সমস্ত কোম্পানিতে তল্লাশি হয়েছে সেই সমস্ত কোম্পানির থেকে বিজেপি কম টাকা পেয়েছে আর বেশী টাকা পেয়েছে সেই কোম্পানি থেকে যাদের কোনো তল্লাশি হয়নি।
নির্বাচনী বণ্ড থেকে মোট যা টাকা উঠেছে তার ৪৭ শতাংশ পেয়েছে বিজেপি আর ৫৩ শতাংশ বিরোধীরা। আর যে দলগুলির ক্ষেত্রে নির্বাচনী বণ্ড দ্বারা প্রাপ্ত অর্থ ৯১ বা ৯৩ শতাংশ তারা এই কালোবাজারে কী করবে ভাবতে গেলে বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে!
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই কোম্পানিগুলো কি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলিকে টাকা দেবে না? হ্যাঁ, নিশ্চিত ভাবে দেবে। কিন্ত কালো টাকা দেবে। সাদা নয়।
এই রায় কালো টাকার আদানপ্রদানকে সুনিশ্চিত করল।